শতবর্ষের আলোকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় :এক অফুরান আকর

 শ্রদ্ধা ও স্মরণেঃ—দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


আগুনের গোলাটা রাস্তা হেঁটে বেড়ায়-খুঁজে ফেরে দু'মুঠো ভাতের গন্ধ- উলঙ্গ ছেলেটা আকাশে হাত বাড়িয়ে মুঠো মুঠো মেঘ খায়-সকলের রাস্তায় শুয়ে মৃত্যু জীবনকে হাতছানি দেয়--জীবন, ভালো বাসা সব যেন বুকের পাঁজরে ভরতে চায় "ঘর, ফুটপাত,আহার,বাতাস,", বিপ্লবের আগুনপতাকার গগনভেদী স্ফূরণ "এক থালা গরম ভাত হাজার ফুল ফোটায় "..

     চুম্বকে এই রূপরেখাই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বাভাবিকতার ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়া এক আগুনখেকো মুখ, রক্তমসির কবি। জন্ম ১৯২০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রম পুরে। স্কুল ও কলেজ জীবন কলকাতার আকাশে পল্লবিত।রিপন স্কুল ও কলেজ চলে শিক্ষা। সঙ্গে চলে বিপ্লবের উদ্বোধন। স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন কালবোশেখী হাওয়া আনতে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার দৃপ্ত বাসনায়।পরে জীবনে যোগ হয় বামপন্থী রাজনীতি। বাঁচার উৎসমুখ সংগ্রাম অভিসারী হয়ে ওঠে।রাতের খসে পড়া তারায় জীবনের অভিলাষ খোঁজা নয়, প্রেমিকার কোমল চাহনীতে রজনীগন্ধা আঁকা নয়--মানুষকে " মায়ের আঁচলের মতো" এক পৃথিবী দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যেখানে  " গান থাকে যখন শিশুদের ঘুম পায়"। যেখানে শীতের রাত মানে শুধুই গরম জামা খোঁজা নয় সারারাত। যেখানে বেঁচে থাকা মানে "হা অন্ন! হা অন্ন!" নয়। যেখানে বাঁচা হল জীবনের সহজ ধারা স্রোত-সহজিয়া শ্বাস প্রশ্বাস!

  প্রেম, প্রকৃতি, জীবনের বৃত্তে পড়ে থাকা মানুষ, সংগ্রামী আন্দোলন-সব কবিতা র শব্দ হয়ে পথ চলা শুরু করে।সহজগতি জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিটি বুননে। কবিতার মনন,শীলন, যাপন বলে চলে যেন বাঁচার অধিকারের কথা। লড়াই করে ছিনিয়ে নেওয়া প্রতি শ্বাসের অক্সিজেন। নগ্ন মায়ের শরীর মোড়ানো আঁচল, প্রতি শিশুর ভরা পেটে মায়ের স্তনবৃন্তে নরম আদরের আঁচড়।

        লড়াই জীবনের জোগান।জীবন যেন নিশ্চিত ভাত রুটির আখ্যান হয়! 

"শুধু দুইবেলা দু'টুকড়ো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যের ও আগে উঠি
ঝড়ো সাগরের টুঁটি ধরে দিই নাড়া
উপড়িয়ে আনি কারাকোরামের চূড়া
হৃদয় বিষাদ চেতনা তুচ্ছ গণি
রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি।"

       ক্ষমতার অলিন্দে শোষনের ভাষা বদলায়, রং বদলায়।তাই আগুন লড়াই যেন প্রাত্যহিক জীবনলিপি।

" রাজা আসে যায় আসে আর যায়/ শুধু পোষাকের রং বদলায়/ শুধু মুখোশের ঢং বদলায়/...দিন বদলায় না।" 

তাই তাঁর কবিতায় লড়াই হল দিন বদলের স্লোগান। কলমের প্রতিটা আঁচড় কখন যেন প্রতিবাদ প্রতিরোধের ফল্গুধারা। সুদিন আনার প্রত্যাশা কি জীবনের কাছে স্বাভাবিক হবে না? জীবন পুড়লে রোষের আগুন কি শোষন অসুরকে পুড়িয়ে বিলীন করে দেবে না এই মাটিমায়েরই দেহে? শোষনের উত্থান এবং পতন কি সমার্থক হয়ে উঠবে না খিলখিল জীবনের প্রত্যাশায়?

      প্রথমদিকে জীবনানন্দ ধারণ কলমচারিতায় লক্ষ্য করা যায়।" এমন ঘুমের মতো নেশা" বা " এমন মৃত্যুর মতো চিতা"! জীবনানন্দের মাঠ ঘাট ফুল পাখি ব্যঞ্জনাময় হলেও কবির কলম দ্রুত নিজের ছন্দ তৈরি করে রাজনৈতিক আন্দোলনের জারিত আগুনে।কবি তৈরি করেন নিজের জগৎ, নিজস্ব কলমশৈলী। সমাজতন্ত্র প্রোথিত করতে হবে জীবনে--তবেই হবে জীবনে জীবন যোগ। ম্লানিমায় সবুজ চাঁদনী চাই। অধিকারের নিশ্চিত ভাতের গন্ধ যেন মিশে যায় অক্লেশে। রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যোগদান করেন।জেলযাপন জীবনকে যেন আরো প্রতিবাদী করে তোলে। বঞ্চনার আগুনে সেঁকে নিজেকে ঋদ্ধ করেন।করেন আরো প্রাণময়। পড়ে যেতে যেতে আঁকড়ে ধরেন কবিতার আঁচল। কবিতার নরম আশ্রয়ে নিবিড়তার গন্ধ খুঁজতে থাকেন অহর্নিশ।

       উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থরা তাঁর জীবনের সৃজনশীলতারই প্রকাশ।' গ্রহ চ্যুত'(১৯৪২) তাকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে না পারলেও ' রানুর জন্য'(১৯৫২) তাকে সেই অধরা প্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়।এরপর একে একে বিস্ফোরণ--আবেগের অভিঘাত আছড়ে পড়তে থাকে জীবন সমুদ্রের তটে।তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি  হলো  — লখিন্দর (১৯৫৬), ভিসা অফিসের সামনে (১৯৬৭), মহাদেবের দুয়ার (১৯৬৭), মানুষের মুখ (১৯৬৯), ভিয়েতনাম: ভারতবর্ষ (১৯৭৪), আমার যজ্ঞের ঘোড়া: জানুয়ারি (১৯৮৪)। পাশে পাশে চলতে থাকে কবিতার অনুবাদ। বাংলা সাহিত্যে এইরকম হীরকশৈলী তাঁর জয়ধবজাকে পতপত করে উড়িয়ে নিয়ে চলে দিন বদলের হাওয়ায়। সম্পাদিত কবিতা বুলেটিনের সংখ্যা পাঁচশোর ও বেশি। বড়ো কোন প্রাতিষ্ঠানিক ছত্র ছায়ায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পান নি।তার স্ব-উজ্জ্বল জীবনবোধ ই তাঁর জীবনের অভিমুখ নির্দেশ করে দিয়েছিল।অদম্য মানসিকতার বিচ্ছুরণ তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে।

       ব্যঙ্গের যে শাণিত ছুরি চালিয়েছেন প্রতিবাদের সোচ্চারতায় তার নিদর্শন বাংলা সাহিত্যে অনন্য করে রেখেছে তাকে।

" যারা কথা বলছে,তারা বোবা,
যারা শুনছে সকলেই
জন্ম থেকে বধির।অথচ
সভায় মিছিলে তিলধারণের ঠাঁই নেই।"

অথবা

" যদি সে উপোস জানত/
তারজন্য প্রতিদিন সোনার থালায়/পর মান্ন আনত সুজাতা/ কিন্তু সে সন্ন্যাসী নয়, সাধারণ নির্বোধ মানুষ।"

    ' আর এক মহিষাসুর' কবিতায় সেই কালজয়ী বিদ্রুপের আলপনা- 

"অসুর রে! তুই যাত্রাদলে যেই লেখালি নাম/ হলি মহিষাসুর,সে কী তিড়িং নাচ তখন তোর/ বাপ রে সে কী ভয়-দেখানো সার্কাসের খেলা।"

         " পাপকে চুমা খেয়ে, তাদের পায়ের নীচে মাথা রেখে" অমল হতে চাননি। শিরদাঁড়ার ঋজুতা তাই আকাশ ছুঁতে চায়। স্বপ্নরা ডানা মেলে মেঘের সাথে উড়ে চলে সব পেয়েছির দেশে। বড়ো ভালো লাগা যে সে বাঁচায়! বড়ো প্রাণ সুখ সে আশায়!

       ভালোবাসা তার কবিতায় কখনও মিলনের শীৎকার-মোহ, কখনও একাকী নির্জনে বিষাদবারি সিঞ্চনে ও বারে বারে মিলনের অজেয় অনুভব!

" নেশা যেন ধরে যায় ছেলেটির বাঁশিতে/ মনে হয় দোষ নেই ভালোবাসা বাসিতে।"

অথবা

    বিষাদ যেন সমস্ত রাত একাকী নির্জন/ স্বপ্নে পথ হাঁটা।/ ভুলেই গেছি কবে,কাকে দিয়েছিলাম মন/ কিছুই আজ পড়ে না মনে/সারা রাত ঝরেছে ফুল। ভালোবাসা! তুমি এখন/কেমন আছো?"

       বড়ো মায়া ছিল তার বুকে।এক শোষণহীন নিশ্চিত যাপনের আশ্বাস ছিল তার কলম জুড়ে। সমস্ত জীবনই তিনি হেঁটে চলেছেন স্বপ্ন-জারণে ।নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন--এক লালতিলক দিনের স্বপ্ন!

  " এমন একটা পৃথিবী চাই----/শুকনো কাঠের মতো মায়েদের/ শরীরে কান্না নিয়ে নয়/ বুক ভর্তি অফুরান ভালোবাসার/ শস্য নিয়ে"।

       কবিতায় আলোর যাত্রী তিনি।দিক্ চক্র বালে হিরণ্য গর্ভ আলোর অভীপ্সা। পুঞ্জিত ব্যথা স্রোতের ছলাৎছল নতুন দিন যাপনের গান লিখে যায়।কবির অশেষ ইচ্ছা তাই কান্নার শরীরেও আলো আনুক। জীবনের পানপাত্র ভরে উঠুক আনন্দ ধারায় --- আনন্দ রূপম্ মৃতং যদ্বিভাতি!

    " হে যুবক,হে যুবতী, পৃথিবীতে তোমাদের কতটুকু দাম?/ কান্নাকে শরীরে নিয়ে কার ঘরে কয় ফোঁটা দিয়ে গেলে আলো?"

প্রতিবাদী ও প্রেমের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দিনে তাঁর লেখা কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে কবিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি-         


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি চন্দন রায়ের কবিতা সংকলনের রিভিউ

প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার দ্রুতি ও মন্দন

কবিতা অঞ্জলি: পূর্ণতার উড়ান